হোলি আর্টিজানে হামলার তদন্ত কত দূর ?

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলার ক্ষত এখনো দগদগ করছে। এরই মধ্যে আজ শনিবার এই হামলার বছর পূর্ণ হলো। মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তবে চলতি বছরই অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি এ মামলার অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর কথায় তদন্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি উঠে এসেছে।

মামলার সারসংক্ষেপ
# মোট যুক্ত ২২ জন

# পাঁচজন হামলার পরে অভিযান ‘থান্ডার বোল্টে’ নিহত

# আটজন পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত। তাঁরা হলেন তামিম, জাহিদ, মারজান, সরোয়ার জাহান, আবু রায়হান তারেক (কল্যাণপুরে নিহত), ফরিদুল ইসলাম আকাশ (গাজীপুরে নিহত), তানভীর কাদরী ও আবদুল্লাহ (কল্যাণপুরে নিহত)

# চারজন গ্রেপ্তার। এঁদের মধ্যে তিনজন—রকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী, বড় মিজান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আরেকজন হাসনাত করিম। তাঁকে এখনো সন্দেহভাজন হিসেবেই রাখা হয়েছে, সুনিশ্চিত কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলেনি।

# পাঁচজন পলাতক (সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‍্যাশ, বাশারুল্লাহ ওরফে চকলেট, হাদিসুর রহমান সাগর ও ছোট মিজান)। এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজনকে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে।

# নিহত ভিকটিমদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন গত ১৯ জুন পাওয়া গেলেও নিহত হামলাকারীদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি।

# পরিকল্পনা হয় গত বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে। আট থেকে নয় লাখ টাকা খরচ। দেশি উৎস থেকেই অর্থ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। অস্ত্র ও বিস্ফোরক এসেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর থেকে।

# গাইবান্ধায় প্রশিক্ষণ দেন নিহত মেজর জাহিদুল ইসলাম। তা ছাড়া এ দলটি ঝিনাইদহে অবস্থানকালীন কয়েকটি ঘটনায় যুক্ত হয়ে হাতে-কলমে রিহার্সাল করে।

হোলি আর্টিজানে হামলার পুরো ঘটনা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এই ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গত ২০ জুন গণমাধ্যমকর্মীদের মামলার অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেন। তাঁর বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো:

গত বছরের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে যে হামলা, এটা আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে তুলনীয়। এতসংখ্যক বিদেশি কখনো এর আগে মারা যায়নি এবং যে নিষ্ঠুরতা তা আগে দেখা যায়নি।

এ হামলার সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত, অর্থাৎ যাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই নিহত হয়েছেন। এর বাইরে এ ঘটনার সঙ্গে পরিকল্পনা, সহযোগিতায় নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে—এ রকম অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে হোলি আর্টিজান হামলায় যুক্ত ছিলেন, এ রকম আটজন নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা বেঁচে থাকলে এ মামলার আসামি হতেন। গ্রেপ্তার আছেন চারজন। এঁদের মধ্যে তিনজন নিজেদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এখনো পাঁচজনকে খোঁজা হচ্ছে। এঁদের মধ্যে আর দু-একজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলে তদন্ত শেষ করা যাবে। পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা না গেলেও চেষ্টা থাকবে এ বছরের মধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে।

হামলার পরিকল্পনা
মনিরুল বলেন, এ হামলার পরিকল্পনা হয় গত বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে। তারা ঢাকায় এমন বড় ধরনের কিছু একটা করবে, যাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাভারেজ পাওয়া যায়। পাশাপাশি বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, এটি তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। এই পরিকল্পনা সামনে রেখে তারা ক্যাডার বাছাই শুরু করে যে কাদের এ কাজে লাগানো যায়। তারা সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে ঢাকায় কোনো হামলা করতে গেলে অবশ্যই ঢাকার ছেলে লাগবে, যাদের ঢাকা শহর সম্পর্কে ধারণা আছে। সে রকম তারা তিনজনকে বাছাই করে। এই তিনজনের আগে থেকেই এক বা একাধিক খুন করার অভিজ্ঞতা ছিল। তবে এরা শেষ পর্যন্ত নৃশংসতার মাত্রা ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে আরও দুজনকে বাছাই করে, যারা এর আগে অনেক খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের বগুড়া থেকে আনা হয়। ফলে তারা তিনজন শহুরে ও দুজন মফস্বলের হার্ডেন্ড ক্রিমিনাল বাছাই করে তাদের ভিন্ন ধারার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেটি গাইবান্ধায় হয়। রূপনগরে নিহত মেজর জাহিদ মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করতেন। গাইবান্ধার একটি চরে ক্যাম্প করে ২৮ দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেয়। এরপর তারা ঘটনাস্থলের (হোলি আর্টিজানের) কাছাকাছি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে তাদের রাখে। তখনো তারা টার্গেট হিসেবে হোলি আর্টিজানকে নির্ধারণ করেনি। তবে তাদের লক্ষ্য ছিল গুলশান-বনানী এলাকার কোথাও হামলাটা চালানো। তারা একপর্যায়ে হোলি আর্টিজানকে বাছাই করে। তারা নিশ্চিত হয় যে হোলি আর্টিজানে প্রচুর বিদেশির আনাগোনা আছে, শুক্রবারে আনাগোনা আরও বাড়ে।

হামলা
নির্ধারিত দিনে বাছাই করা পাঁচজন হামলা করে। হামলা পরিচালনার সময়ই কিছু ভিকটিমের মোবাইল নিয়ে ছবি তুলে তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠায়। তামিম ও মারজান দুজনই তখন শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় ছিলেন। এরপর সেই ছবিগুলো তামিম ও মারজান কার কাছে, কোথায় পাঠিয়েছিলেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। কারণ, তামিম ও মারজানকে জীবিত ধরা যায়নি। হামলাকারীরা হামলা করতে যাওয়ার সময় কোনো মোবাইল বা কোনো ধরনের ইলেকট্রনিকস ডিভাইস নিয়ে যায়নি। তারা ভিকটিমদের মোবাইল বা আইপ্যাড ব্যবহার করেছে।

হেঁটে-রিকশায় হামলাস্থলে
মনিরুল বলেন, বসুন্ধরার বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে রিকশায় ও পরে হেঁটেই তারা ঘটনাস্থলে এসেছে। সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, তারা যেসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক সেখানে ব্যবহার করেছে এবং অন্যান্য সামগ্রী টি-শার্ট, কেডস, ব্যাগপ্যাক সংগ্রহ করেছে। এটা একটা লো কস্ট টেররিজম। আট-নয় লাখ টাকার বেশি এদের অভিযানে খরচ হয়নি। মোটামুটি সচ্ছল কিছু লোকজন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তানভীর কাদরী একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করতেন, তাঁর স্ত্রীও একটি মাল্টিন্যাশনাল এনজিওতে কাজ করেছেন। ঘর ছাড়ার (হিজরতের) আগে তাঁরা তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট ও গাড়ি বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন। সুতরাং বলা যায়, তাঁরা এ অভিযানের জন্য বাইরে থেকে টাকা এসেছে, এ রকমটা এদের না হলেও নয়। ফলে অর্থের জন্য তাদের খুব বেশি বাইরের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি।

আর্মস, এক্সপ্লোসিভ
মনিরুল বলেন, তারা অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছিল চাঁপাই ও যশোর দিয়ে। চাঁপাইয়ের একজন মিজানুর ওরফে বড় মিজান এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অস্ত্র ও বিস্ফোরক কে, কীভাবে এনেছিল, সেটি তদন্তে জানা গেছে। ওই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলে পুরোপুরি চিত্রটা পাওয়া যাবে।

এ হামলায় লাভবান যারা
মনিরুল বলেন, এটি তারা করেছিল জানান দেওয়ার জন্য, এটা একটা বিষয়। তাদের (জঙ্গিদের) নিজস্ব কিছু স্বার্থ ছিল। এ হামলার পরে তাদের আশা ছিল প্রচুর মানুষ তাদের প্রতি আস্থা রেখে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। অর্থাৎ তাদের নিয়োগে আরও সুবিধা হবে। এ ছাড়া তাদের আশা ছিল, এই হামলার পরে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অনেক টাকা পাবে।

ঝিনাইদহে নিবরাস ছিল
এ হামলার পরিকল্পনার আগে নিবরাসরা ঝিনাইদহে ছিল। তবে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ঝিনাইদহে রাখা হয়েছিল, এমন নয়। তারা সেখানে অবস্থান করেছে। তারা হোলি আর্টিজান হামলার বেশ আগে ঘর ছেড়েছে। তখন তাদের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ঝিনাইদহের বেশ কিছু ঘটনায় তারা অংশ নিয়ে হাতে-কলমে জঙ্গিবাদের রিহার্সাল দিয়েছে।

হামলায় যুক্ত কতজন এখনো গ্রেপ্তার হননি
মনিরুল বলেন, আমরা অন্তত তিনজনকে গুরুত্বপূর্ণ আসামি মনে করছি। এদের একজন সোহেল মাহফুজ। আর দুজনের কথা বিভিন্ন জবানবন্দিতে এসেছে। এরা হলো রাশেদ ওরফে র‍্যাশ ও বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট। এদের পেলে মামলার তদন্তকাজ শেষ করা যাবে। এদের খুব বড় ধরনের ভূমিকা ছিল এ হামলা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে।

হাসনাতের কী হবে: তিনি এখনো জেলে
মনিরুল বলেন, হাসনাত এখনো এ মামলার সন্দেহভাজন আসামি। সে কারণে তিনি এখনো জেলে আছেন। তদন্ত শেষে জানা যাবে তাঁর কী হবে।

এখনো যা বাকি
মনিরুল বলেন, প্রথমত তদন্ত শেষ করতে আসামিদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লাগবে। সেটা এখনো পাইনি। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, গত সোমবার হোলি আর্টিজানে হামলায় নিহত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তাঁরা হাতে পেয়েছেন। আর নিহত হামলাকারীদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনো আসেনি। সেটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিদেশ যোগাযোগ
বিদেশে তাদের অন্য কোনো বাংলাদেশি বা অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, এ মামলার যারা মূল আসামি, যেমন তামিম চৌধুরী, প্রশিক্ষক জাহিদ, তানভীর কাদরী, নুরুল ইসলাম মারজান—এঁদের জীবিত ধরা যায়নি। গেলে জানা যেত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বাইরে বা ভেতরে বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল কি না।

Leave a Reply

Facebook
%d bloggers like this:
ব্রেকিং নিউজ