ইশারা ভাষার স্বীকৃতির অপেক্ষা

Signlanguageরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার বছর আগে ইশারা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার পথে বাধা কাটছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলা ইশারা ভাষাকে দেশের শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের ‘প্রথম ভাষা’ অভিহিত করে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার (বিএনএফডি) সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “এই ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং প্রতিষ্ঠানিক বিকাশের সীমাবদ্ধতাই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়।”
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশরা ভাষা দিবস উদযাপন শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষায় ভাষা জটিলতা কমাতে এবং ভাষার স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই তার বিশ্বাস।

বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরমেন্স রিপোর্ট (এএসপিআর) ২০১২ অনুসারে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। আর শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সোসাইটি অব দি ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স (এসডিএসএল) এর তথ্য অনুযায়ী দেশে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জাতীয় বধির ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান প্রকাশ করা হয়।

২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইশারা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিলে ২০১১ সালের মে মাসে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিবছর ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিষয়টি এখন মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায়।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসডিএসএলের সমন্বয়ক শান্তনু দে বলেন, “চলতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস উদযাপনের জন্য ২৬ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি সভা ডাকে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সেখানে আমাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সভায় গিয়ে জানা গেল, বিষয়টি অনুমোদনের জন্য এখন পর্যন্ত কেবিনেটেই পাঠানো হয়নি।”

আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “সমাজসেবা অধিদপ্তরের সক্রিয় সহযোগিতা থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস উদযাপনের বিষয়টি এখনো হলো না।”

শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য দেশের ৭টি বিশেষায়িত স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকের ইশারা ভাষার কোনো প্রশিক্ষণ নেই বলেও জানান শান্তনু।
“৮০ এর দশকের শেষ দিকে এ বিষয়ে কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই এখন অবসরে।”

signbookশ্রবণ প্রতিবন্ধীর কল্যাণে সরকারিভাবে ইশারা ভাষার স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসা এসডিএসএল এর সভাপতি এম ওসমান খালেদ দোভাষীর মাধ্যমে এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি বাস্তবায়নে সম্প্রতি সরকার এই শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও শিক্ষকদের উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে।

“একই কারণে আমারা আশা করি, বাংলা ইশারা ভাষা দিবসের স্বীকৃতি শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা সৃষ্টির পথ প্রশস্থ করবে।”

তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ইশারা ভাষা চালু, এই ভাষায় দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সব স্তরে পেশাজীবী ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ মহিলা বধির কল্যাণ সংস্থার সভাপতি শিরীন বেগমের মতে, “শিশুর বিকাশে ভাষা সবচেয়ে গুরুত্বরপূর্ণ। কিন্তু এই ভাষার স্বীকৃতির অভাবে, অভিভাবক ও শিক্ষকরা দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন।”

এসডিএসএলের শান্তনু দে এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, শিশু কথা বলতে শেখে আশেপাশের মানুষকে অনুকরণের মাধ্যমে। অর্থাৎ শুনে শুনে সে ভাষা শেখে। শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা শুনতে পায় না বলে উচ্চারণ করা শেখে না। তাই জন্ম থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা কথা বলতে শেখে না। এ কারণেই যোগাযোগের জন্য তাদের ইশারা ভাষার দরকার হয়।

“জনসংখ্যার বিচারে এটিই দেশের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হওয়া উচিৎ। অথচ এই ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, কিংবা আদালতেও আলাদা কোনো সুবিধা নেই।”

শান্তনু দে জানান, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধীদের অধিকার সনদ এবং ঐচ্ছিক প্রতিপালনীয় বিধি বিধান অনুসমর্থন করেছে। এই সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে সারা বিশ্বে কার্যকর হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত এই সনদে ইশারা ভাষার স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এই সনদের ধারা-২ এ ভাষার সংজ্ঞায় ইশারা ভাষাকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শ্রবণ প্রতিবন্ধী মোহাম্মদ আলী এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “আমেরিকায় শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে যে সুযোগ আছে তা খুবই অপ্রতুল।”

সরকার বাংলা ইশারা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিলে শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারবে বলেই তার বিশ্বাস।

ষোড়শ শতকে ইউরোপের দেশগুলোতে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ইশারা ভাষার বিকাশ ঘটে। অধিকাংশ ইশারা ভাষা প্রাকৃতিক এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা রীতি অনুযায়ী গড়ে ওঠে। এটি নির্ভর করে গতানুগতিক ধারণা, মুকাভিনয়, হাতের অবস্থান এবং আঙুলের কাজের ওপর। হাতের অবস্থান যার যার ভাষার বর্ণমালাগুলো চিহ্নিত করে। এটি সবক্ষেত্রে শুধু একটি শব্দকে উপস্থাপন করে না বরং একটি বাক্যের গোটা ভাবও বোঝায়।

ঢাকা বধির সংঘের সভাপতি মিজানুর রহমান যতদ্রুত সম্ভব ইশারা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে বলেন, “একটি দিবস মানুষের সচেতনতা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির অনেকখানি বদলে দেয়।”

Leave a Reply

Facebook
%d bloggers like this:
ব্রেকিং নিউজ