মার্কিন সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক

garmentsরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলছে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে শ্রমিক সংগঠনগুলো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই।

তবে দেশের রপ্তানিতে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করছেন তারা।

এদিকে মার্কিন সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ অভিহিত করে শিগগিরই আবার এই সুবিধা ফিরে পাওয়ার আশা প্রকাশ করছে বাংলাদেশ সরকার।

কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র।

গত কয়েক মাসের শুনানির পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।জিএসপি সুবিধা স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে শ্রমিক সংগঠনগুলো জানায়, সিদ্ধান্তের পেছনে ‘স্পষ্ট ও যৌক্তিক’ কোনো কারণ তারা দেখছেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমরা হতবাক। এর কোনো যৌক্তিক কারণ দেখছি না। কেন তারা এই সিদ্ধান্ত নিল তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।”

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “জিএসপি নিয়ে অনেক দিন ধরেই শুনানি চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার কথা বলেছে। আমরা তা করছিও। সরকার শ্রম আইন সংশোধন করছে। এছাড়া কারখানার কর্ম পরিবেশ ও শ্রমিকদের জীবন-মান উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। এসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে জানানোও হয়েছে।”

নিট পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মো. হাতেমের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যে সময়ে এসে যেভাবে জিএসপি স্থগিত করল- তা ‘অন্যায়’।

“তারা কর্মপরিবেশ ও শ্রম মান নিয়ে যে কথা বলছে তা ঠিক না। আমরা আইএলওকে সঙ্গে নিয়ে কর্মপরিবেশ ও শ্রম মান উন্নয়নে কাজ করছি।”

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসে ১২ শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেও তা শ্রমিকদের কাজে আসবে না বলে মনে করেন পোশাক খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা।বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “তারা বলছে, এটা তারা শ্রমিকদের স্বার্থে করেছে। কিন্তু এতে করে শ্রমিকদের কোনো উপকার হবে না। তারা বরং কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানে মজুরি দেয়া কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও মালিকপক্ষকে চাপ দিতে পারতো।”

যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানকে ‘অনৈতিক’ উল্লেখ করে গার্মেন্ট-শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু জিএসপি স্থগিত করার বিষয়টিকে দেখছেন ‘বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একটি পদক্ষেপ’ হিসাবে।

“বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর কোনো যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না।”

বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার মনে করেন, সরকার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বিবেচনায় না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রর জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত ‘একেবারেই ঠিক হয়নি’।

আর জিএসপি স্থগিতের এই সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে সরকার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, “দেশের কারখানাগুলোর নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার যেখানে বেশ কিছু উপযুক্ত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের কারখানার শ্রমিকদের জন্য জিএসপি বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের চেয়ে দুঃখজনক খবর আর হতে পারে না।”

বাংলাদেশ সরকার যেখানে তাদের বাণিজ্য সহযোগীদের ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখিয়ে আসছে সেখানে জিএসপি বাতিলের এই কঠোর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সম্প্রসারণে ‘নতুন করে বাধা’ সৃষ্টি করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সরকারের এই বিবৃতিতে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জিএসপি সুবিধা দিয়ে থাকে। সরকার আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন শিগগিরই বাংলদেশকে এই সুবিধা ফিরিয়ে দেবে।”

‘প্রভাব পড়বে না’

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিতে দেশের রপ্তানিতে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আর রপ্তানিকারকরা।

ইপিবির ভাইস-চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পায় না। দেশটিতে মোট রপ্তানির ৮৬ শতাংশই তৈরি পোশাক পণ্য হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত মোট রপ্তানিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।”

জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারতো, যদিও এর মধ্যে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ছিল না।

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ, যার পরিমাণ ৫১০ কোটি ডলার। এর মধ্যে শুধু তৈরি পোশাক পণ্য থেকে আয় হয় ৪৫৩ কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য প্রতিনিধির হিসাবে, গতবছর জিএসপির আওতায় তিন কোটি ৪৭ লাখ ডলারের তামাক, ক্রীড়া সরঞ্জাম, চিনামাটির তৈজসপত্র ও প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এতে তারা শুল্ক ছাড় পেয়েছেন ২০ লাখ ডলারের মতো।

জিএসপি বাতিল করায় এখন শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। এতে তাদের লাভ কমে যাবে।

কিন্তু শুভাশীষ বসু বলেন, “এতে রপ্তানি কমবে না। কারণ যেসব পণ্যে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায় সেসব পণ্যে বাংলাদেশের বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট সক্ষম।”

যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে না বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম ।“বিশ্বের অন্যান্য বাজারে হয়তো আমরা চাপের মধ্যে পড়ব। তবে রপ্তানি কমে যাওয়ার মতো কিছু ঘটবে না।”

বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মো. হাতেমও বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না। তার যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করলেও আমদানি বন্ধের কথা বলেনি। তাছাড়া বিদেশি ক্রেতারা কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি সরেজমিনে দেখেই কার্যাদেশ দেয়।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের যেসব পণ্য জিএসপি সুবিধা পেত সেগুলো আমাদের রপ্তানি আয়ে খুবই নগন্য অবদান রাখে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে আমাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।  ”

আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরও বিদেশি ক্রেতারা তাদের ‘দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত অংশীদার’ বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাবে।

শঙ্কা ইউরোপ

gspUSAমার্কিন এই সিদ্ধান্তের পর বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি বাতিলের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ২০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা হয়তো নেই, কিন্তু এই সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যদি একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানিবাজার বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

 

তাই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পর রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করলেও এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের শঙ্কা ইউরোপ ও কানাডার মতো বাজার নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বেশিরভাগটাই রপ্তানি হয়।

“আমরা ভয় পাচ্ছি, আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ অন্যান্য প্রধান বাজারে না পড়ে। ওরা যদি তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) অনুসরণ করে, তাহলে আমাদের রপ্তানি মহা সঙ্কটে পড়বে।”

তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো সিদ্ধান্ত ইইউ বা অন্যরা নেবে না। সরকার ইতোমধ্যে পোশাক খাতের পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তাছাড়া অন্য বাজারগুলো যেভাবে আমাদের জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে তা স্থগিত করা সহজ নয়।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামের পোশাক কেনে, যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সদস্য এ কে এম জহিরুল কাইয়ুম খান বলেন, “এককভাবে প্লাস্টিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশি রপ্তানি হয় না। তবে এ সিদ্ধান্ত যদি অন্যান্য আমদানিকারক দেশও নেয় তাহলে সমস্যা বাড়বে।”

শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কঠোর পদক্ষেপ’ অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যদি জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দেশের পোশাক খাত এবং এ খাতে জড়িত ৩৬ লাখ শ্রমিক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গার্মেন্ট-শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, “এখন যদি ইউরোপও এই নীতি অনুসরণ করে আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে গোটা ইন্ডাস্ট্রি হুমকির মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট এক কোটিরও বেশি মানুষ।”

Leave a Reply

Facebook
%d bloggers like this:
ব্রেকিং নিউজ