রাজস্ব আদায় বাড়াতে অটোমেশনে জোর
নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসিনিউজবিডি, (১৯ ডিসেম্বর) : দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখের মতো কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাদের মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ৪০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে তাদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। চলিত করবর্ষে আরও ৫০ লাখ করদাতাকে অন লাইনে রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এভাবে মোট ৭০ লাখ করদাতাকে অন লাইন রিটার্নের আওতায় আনা হবে।
গত আগস্টে ৫ ধরনের করদাতা ব্যতীত সব করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, অনলাইনে রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার ফলে এ বছর রিটার্নধারীর সংখ্যা বাড়বে।
গত বছর নির্দিষ্ট এলাকার অধিক্ষেত্রের ব্যক্তি করদাতা, সারা দেশে ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। সেই সময় ১৭ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছিলেন।
এদিকে কর জাল সম্প্রসারণ ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন ১২টি কমিশনারেট, কাস্টমস হাউস ও বিশেষায়িত ইউনিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। এসবের আওতায় এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগে মোট তিন হাজার ৫৯৭টি নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে।
এনবিআর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভ্যাট অটোমেশনের মাধ্যমে আগামী বছর ১ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি আগামীতে ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা ও সেবাপ্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। সেই হিসেবে ভ্যাটের আওতা আর বিস্তৃত করা হবে।
এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ লাখ ৪৪ হাজার। ই সহগ, ভ্যাট স্মার্ট চালান, ভ্যাট ফাঁকি মোকাবিলায় রিস্ক-বেজড অডিট সিস্টেম চালুসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও ১ লাখ নতুন ভ্যাট নিবন্ধনের কাজ চলমান।
অটোমেশনের বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করতে হলে সিস্টেম ও প্রসেসে উন্নতি করতে হবে। রাজস্ব আদায় সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং, চ্যালেঞ্জটা বড় হলে চেষ্টাটাও বড় হয়। কোনো অবস্থায় করদাতাকে জুলুম যেন না করা হয়। এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে আমরা জোর চেষ্টা করছি। প্রথমবারের মতো অডিটের নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। সেখানে করদাতার কর দেওয়ার যোগ্যতা আছে কি না সেটা দেখার কথাও বলা হয়েছে। আমরা কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে চাই।
অটোমেশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, অটোমেশন ছাড়া দুর্নীতি কমবে না। বন্ডসহ সব প্রক্রিয়া দ্রুত অটোমেশনে যেতে হবে।
অটোমেশনে আরও যত উদ্যোগ
নিরীক্ষা বা অডিটের মাধ্যমে কর নথি যাচাই-বাছাই করা হয়। রিটার্নের করদাতারা যে হিসাব-নিকাশ করছেন এবং কাগজপত্র জমা দিয়েছেন, তা ঠিক আছে কি না, পরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষাকালে প্রয়োজনে প্রমাণপত্র হিসেবে বিভিন্ন কাগজপত্র চান কর কর্মকর্তারা। আগে করদাতার রিটার্ন নিরীক্ষা হতো ম্যানুয়াল। একই করদাতাকে বারবার হয়রানি করা হয়, এমন অভিযোগও আসত। অডিটের জন্য রিটার্ন বাছাই করার ক্ষেত্রে ঝুঁকিভিত্তিক পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। শতভাগ তথ্য না থাকায় এখনই পুরোপুরি অটোমেটেড সিস্টেম চালু করতে পারছে না এনবিআর।
গত ১০ নভেম্বর অনলাইনে ভ্যাট ফেরত (রিফান্ড) আবেদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং করদাতার ব্যাংক হিসাবে সরাসরি অর্থ স্থানান্তরের লক্ষ্যে অনলাইন ভ্যাট রিফান্ড মডিউল চালু করে এনবিআর।
বন্ড অটোমেশন, বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো চালু, গ্রিন চ্যানেলের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি, আংশিক রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ড সুবিধা চালু, বন্ডেড পণ্যের এইচএস কোডে অমিল হলেও দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা, কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিবিএমএস) চালুসহ একাধিক অটোমেশন প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনবিআর।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীরের মতে, অটোমেশনের কারণে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা উন্নতি হবে। তবে কর আদায় বাড়াতে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতির প্রয়োজন।
চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরের প্রথম চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বছর ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ছিল। তবে গত ২৪ নভেম্বর এই লক্ষ্যমাত্রা আরও ৫৪ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এনবিআর নতুন করে ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর আগে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলেও বাড়ানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে প্রথম।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ড. মাহফুজ কবীর বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকারের নেওয়া উচিত। এখন যদি অর্থবছরের মাঝখানে এমন সিদ্ধান্ত আসে তাতে আসলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এ কারণে এই পরিবর্তন কতটা যুক্তিযুক্ত হলো তা বিবেচনার দাবি রাখে।
মনোয়ারুল হক/
