আইনি পথেই নিষিদ্ধ হতে পারে আওয়ামী লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক (ঢাকা), এবিসি নিউজ, (৮ অক্টোবর) : আওয়ামী লীগের অপরাধের তদন্ত করতে ইতিমধ্যে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেবে প্রসিকিউশন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে ভারত থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাস ছয়েক পর দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এর জেরে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার।

এবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দিকে এগোচ্ছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম (প্রশাসন) বলেন, ‘চারটি শাস্তির মধ্যে একটি হচ্ছে দল নিষিদ্ধ করা। অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল দল নিষিদ্ধ করতে পারবেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল কী করবেন, সেটা তাঁর বিষয়। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, তারা (আওয়ামী লীগ) মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতা ইনানকে বলেছেন, “ছাত্রলীগ নামিয়ে দাও”। তিনি জাহাঙ্গীর কবির নানককে বলেছেন, “মোহাম্মদপুরে লোক নামিয়ে দাও”। তাপসের সঙ্গে বলেছেন, ঢাবির তৎকালীন ভিসিকে বলেছেন, “ছাত্রলীগ-যুবলীগকে বলে দিয়েছি”। এসব দলীয় নির্দেশনা।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের গেজেট জারি হয়েছিল গত ১০ মে। ওই গেজেট অনুযায়ী সংশোধিত আইনের ২০বি ধারায় বলা হয়েছে, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ধারা ৩ (২)-এর অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছে, আদেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, উসকানি দিয়েছে, প্ররোচনা দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহায়তা করেছে তাহলে ট্রাইব্যুনাল তার কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করতে, সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করতে, এর নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল করতে এবং এর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকাজ দ্রুতই সম্পন্ন করবেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে দল হিসেবে বিচারের জন্য আওয়ামী লীগের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এর আগে আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের ১২ মে আওয়ামী লীগ এবং এর সঙ্গে যুক্ত সব সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কাজ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এসব অভিযোগ দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিচার ও শাস্তির বেসিক প্রিন্সিপাল (মূল নীতি) হচ্ছে, ঘটনার সময় আইনে অপরাধ হিসেবে বলা না থাকলে পরবর্তী সময়ে আইনে অপরাধ বানিয়ে শাস্তি দেওয়া যায় না। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যেত, তার অধিক বা ভিন্ন সাজা দেওয়া যাবে না।’

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘কোনো দল যদি মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকে, তার আইন অনুযায়ী বিচার হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত জঘন্য-বর্বর ভূমিকায় কোনো রাজনৈতিক দল অবতীর্ণ হয়নি। ১৮ কোটি মানুষের দাবি তাদের বিচার। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। রাষ্ট্র যথাযথভাবেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করতে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। এটি খুবই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। দেশের মানুষের প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগ যে অন্যায় করেছে, তার বিচার হবে। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে।’

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা জাতিসংঘের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতায় টিকে থাকতে আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আন্দোলনকারী ও বিরোধী মত দমনের কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত দিকনির্দেশনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক সাক্ষী তাদের জবানবন্দিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। এর প্রত্যেকটি কাজে লাগবে। কারণ সাক্ষীরা যখন তাঁদের বক্তব্য দিয়েছেন, দলের জড়িত থাকার কথা বলেছেন–এসব জুডিশিয়াল ডকুমেন্ট হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে দলটির বিরুদ্ধে যে তদন্ত হবে, দলের বিরুদ্ধে যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আসবে, তার মধ্যে যেসব সাক্ষ্য এরই মধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে, সেগুলোও অন্যতম এভিডেন্স হিসেবে গণ্য হবে। সাজার বিষয়ে আইনে আছে দল নিষিদ্ধ করা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।’

মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৪ দলীয় জোটের সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্ত এগোলে যদি মনে হয় আরও কোনো দল এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হওয়া দরকার, তখন তদন্ত সংস্থা সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’

এর আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, ছাত্রাবাসে সিট-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এর প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, পরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক হওয়া নাহিদ ইসলামও। তিনি গত ২১ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত অপরাধ। আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা উচিত।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ