জাতিসংঘে যেসব বিষয় তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ, ঢাকা (২৭ সেপ্টেম্বর) : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০ তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি কয়েকটি বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রেখেছেন। এগুলো হলো রোহিঙ্গা সংকট, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের ভূমিকা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান ও গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা।
এছাড়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ আর কখনও স্বৈরশাসনের পথে ফিরবে না। দেশের গণতন্ত্র আর কখনও হুমকির মুখে পড়বে না।
তিনি বলেন, গত বছর ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে’ তরুণসমাজ স্বৈরাচারকে পরাজিত করেছিল। সেই অভ্যুত্থান বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের নতুন পথ খুলে দিয়েছে এবং সেই দায়িত্বই জনগণ তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
সংস্কার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা
ভেঙে পড়া রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাহী আদেশে সংস্কার চালানো সম্ভব হলেও তার সরকার বেছে নিয়েছে কঠিন পথ—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রক্রিয়া। এজন্য বিচার বিভাগ, শাসনব্যবস্থা, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি দমন ও নারী অধিকারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এর ফলস্বরূপ, গত জুলাই মাসে সব দল একযোগে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রমে তাদের সময়বদ্ধ অঙ্গীকার করে।
ড. ইউনূস বলেন, এই অঙ্গীকারের কারণে আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার বাস্তবায়নে কোনো অনিশ্চয়তা থাকবে না।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সতর্ক করে বলেছেন, আট বছর পরও মায়ানমারে চলমান সংঘাত গোটা অঞ্চলের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে, যা এখনো কোনো সমাধানের দিকে যাচ্ছে না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রাখাইনে সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি থেকে জন্ম নেওয়া বঞ্চনা ও নিপীড়ন এখনো চলছে। বৈষম্যমূলক নীতিগুলো দ্রুত বাতিল করতে হবে।”
মায়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি এবং বলেন, রোহিঙ্গাদের সমান অধিকার নিয়ে সমান নাগরিক হিসেবে একীভূত করতে হবে।
একইসঙ্গে তিনি সতর্ক করে বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) বরাত দিয়ে তিনি জানান, “যদি দ্রুত নতুন অর্থায়ন না আসে, তবে মাসিক রেশন কমিয়ে প্রতিজনের জন্য মাত্র ৬ ডলার করা হতে পারে।”
এ সিদ্ধান্ত ক্ষুধা ও অপুষ্টিকে ভয়াবহ করে তুলবে এবং রোহিঙ্গাদের হতাশার পথে ঠেলে দেবে।
‘নবায়নের পথ কখনো হারায় না’—বাংলাদেশের অভ্যুত্থান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, এটি গত বছরের জেনারেশন-জেড নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের পর দ্বিতীয়বার তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখলেন।
তিনি বলেন, “গত বছর আমি এই মহিমান্বিত পরিষদে এমন এক দেশ থেকে আপনাদের উদ্দেশে কথা বলেছিলাম, যে দেশ সদ্য একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়েছে। আমি তখন আমাদের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলাম।”
“আজ আমি জানাতে চাই, সেই যাত্রায় আমরা কতদূর এগিয়েছি। পৃথিবীর প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে প্রায় ৩ জন বাংলাদেশে বাস করেন। কিন্তু আমাদের গল্প শুধু সংখ্যা বা ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সাধারণ মানুষের অসাধারণ শক্তির স্মারক।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের গল্প গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বিশ্বের প্রতিটি জাতির মধ্যে আশা জাগায়—সংকট যত গভীরই হোক, সমাধান যতই অসম্ভব মনে হোক না কেন, নবায়নের পথ কখনো হারিয়ে যায় না।”
প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭১ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে বিদেশে বসবাস করছেন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সালে তারা দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, “তাদের অবদান শুধু বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য নয়, সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্বাগতিক দেশগুলোর জন্যও, যেখানে তারা উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদান করে থাকেন। অভিবাসন তাই উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী—আমাদের জন্যও ভালো, তাদের জন্যও ভালো।”
তিনি স্বাগতিক দেশগুলোকে আহ্বান জানান, প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে।
গাজায় ‘সরাসরি গণহত্যা’ চলছে
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই মতের সঙ্গে একমত যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা একমত যে আমরা এখন সরাসরি গণহত্যা ঘটতে দেখছি।”
তিনি যোগ করেন, “দুঃখজনকভাবে মানবতার পক্ষ থেকে আমরা যথেষ্ট কিছু করছি না এটি থামানোর জন্য। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্য শেষ করেছেন এই বলে, “আমাদের মনে রাখতে হবে, সামনের চ্যালেঞ্জগুলো কোনো একক দেশ একা মোকাবিলা করতে পারবে না। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, আজকের বিশ্বে যখন একটি দেশ সংকটে পড়ে তখন অন্যরাও এর ভুক্তভোগী হয়।’’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন সংকট দেখা দেয়, তখন পুরো বিশ্বের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ে।” সূত্র: আল জাজিরা