তানিয়া হত্যায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে চায় পুলিশ

আশিক মাহমুদ, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা (২৬ এপ্রিল ২০২৪) : তিন মাস আগে রাজধানীর হাজারীবাগে ভাড়া বাসায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ী তানিয়া আক্তার (৩৫) হত্যায় জড়িত মধ্যম সারির এক সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে চেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ। হত্যার ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আসামি কুদ্দুসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা আবশ্যক উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত কুদ্দুসুরকে হেফাজতে পায়নি পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ী তানিয়া আক্তার হাজারীবাগের মিতালী রোডের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। জানুয়ারির শুরুতে ওই বাসায় ওঠেন এবং ১৯ জানুয়ারি নিজ কক্ষে খুন হন তিনি। দুদিন পর ২১ জানুয়ারি তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় ফ্ল্যাটের মালিককে। পরে তদন্তে উঠে আসে, এ ঘটনায় মো. কুদ্দুসুর রহমান নামে সেনাবাহিনীর একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা জড়িত।

নিহত তানিয়ার ভাই ও মামলার বাদী মো. তন্ময় হাসান গত ২১ এপ্রিল (রোববার) এবিসিনিউজবিডিকে জানান, ‘তার বোন খুন হওয়ার কিছুদিন পর তারা জানতে পারেন, এই ঘটনায় কুদ্দুসুর রহমান নামে এক সেনা কর্মকর্তা জড়িত। তিনি বলেন, ‘হয়তো আমার বোনের কাছে ওই কর্মকর্তার এমন কোনো তথ্য ছিল, যা প্রকাশ্যে এলে তিনি বিপাকে পড়তেন। এ কারণেই তিনি তাকে হত্যা কওে মোবাইল ফোনটিও নিয়ে যান।’

তানিয়ার ভাড়া বাসার আশপাশের বিভিন্ন ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ক্যামেরার পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি বিকেল ৫টা ৪২ মিনিটে তানিয়া বাসার গলিতে ঢোকেন। দুই হাতে কাপড়ের দুটি ব্যাগ এবং কাঁধে ঝোলানো ছিল ভ্যানিটি ব্যাগ। পেছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছিলেন সেনা কর্মকর্তা কুদ্দুসুর রহমান। তার পরনে ছিল জ্যাকেট, কাঁধে ব্যাগ (ব্যাকপ্যাক) এবং মুখে মাস্ক ছিলো।

এর কিছুক্ষণ পরের আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ওই বাসা থেকে হুডি পরে বের হচ্ছেন কুদ্দুসুর রহমান, পিঠে ব্যাগ। তাকে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে দেখা যায়।

এর আগে অন্য ফুটেজগুলোতে দেখা যায়, ঘটনার দিন বিকেলে কুদ্দুসুর ও তানিয়া ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। তখন কুদ্দুসুর মাস্ক পরে ছিলেন না। ধানমন্ডি থেকে দুজনে রিকশা নিয়ে হাজারীবাগে ঢোকেন। বাসার কাছাকাছি দূরত্বে এসে তারা রিকশা থেকে নেমে যান। এরপর তানিয়ার পেছনে পেছনে দূরত্ব বজায় রেখে কুদ্দুসুর হাঁটতে থাকেন।

তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তানিয়ার স্বামী কুমিল্লায় থাকেন। দুজনের বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকায় তানিয়া বেশির ভাগ সময় ঢাকায় নিজ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। এর মধ্যে তানিয়ার সঙ্গে কুদ্দুসুর রহমানের সখ্য হয়। তারা নিয়মিত মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন। একটা পর্যায়ে তানিয়া চেয়েছিলেন তাদের বিয়ে হোক। তাদের এই সম্পর্কের বিষয়টা তানিয়া তার দু–’একজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকেও জানিয়েছেন। এমন কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে তানিয়া হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের সূত্র পায় পুলিশ। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে তানিয়াকে হত্যার পর তার মুঠোফোন, জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ, বাসার চাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত কুদ্দুসুর রহমান ব্যাগে ভরে নিয়ে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, কুদ্দুসুর রহমানকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, তানিয়া হত্যার সঙ্গে মো. কুদ্দুসুর রহমান জড়িত। মামলার তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণ, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মুঠোফোনের কলতালিকা, আর্থিক লেনদেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ ও তানিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যালোচনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় আসামি কুদ্দুসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা আবশ্যক।

ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এবিসিনিউজবিডিকে বলেন, ‘সাধারণত বড় কোনো অপরাধে কোনো সেনা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেলে আমরা সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে বিষয়টি অবহিত করি। এই খুনের ঘটনায়ও আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।’ তবে এখন পর্যন্ত কুদ্দুসুরকে হেফাজতে পায়নি পুলিশ।

তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশি কিছু বলতে চাননি। পুলিশের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. ইহসানুল ফিরদাউস এবিসিনিউজবিডিকে বলেন, ‘তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আছে। আমরা তদন্তে সন্তুষ্ট। এর আগে সন্দেহভাজন হিসেবে ফ্ল্যাটের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে যেহেতু আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, এ জন্য এর বেশি বলা যাচ্ছে না।’

গত ২৫ এপ্রিল হাজারীবাগের ওই বাড়িতে গিয়ে তানিয়ার খুন হওয়া ফ্ল্যাটটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কথা হয় ফ্ল্যাটের মালিক মোস্তাকিম আহমেদের (শাহিন) স্ত্রী মাছুমা পারভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় ওই বাসায় দারোয়ান ও সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন জানিয়ে মাছুমা বলেন, ‘আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, এক অফিসার এই কাজ করেছে। এরপরও আমার স্বামী কারাগারে। বাসা ভাড়া দিতে না পারায় আমরা খুব কষ্টে দিন পার করছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ