ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্রে হাসিনার আমলে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচারের কাহিনী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ, (১২ সেপ্টেম্বর) : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন সেই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিলেও কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি ২৮ লাখ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। তথ্যচিত্রে উঠে আসে ব্যাংক লুটপাট, অবৈধ ঋণ, হুন্ডি এবং লন্ডনে সম্পত্তি কেনার মতো দুর্নীতির নানা কৌশল। দেওয়া হয় শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের অবৈধ সম্পদের তথ্য।

এ ছাড়া তুলে ধরা হয় লন্ডনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তির তথ্য। দুর্নীতির এসব ঘটনা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নষ্ট করেছে বলে দাবি করে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখন পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধার এবং দেশটির কাঠামোগত সংস্কারে কাজ করছে বলেও তথ্যচিত্রে জানানো হয়।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস গতকাল চাঞ্চল্যকর তথ্যচিত্রটি প্রকাশ করে। এর শিরোনাম করা হয়, ‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই চুরি’। এতে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক লুটপাট বলে উল্লেখ করা হয়।

তথ্যচিত্রের শুরুতেই উঠে আসে শেখ হাসিনার শাসনের শেষ সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ। বিশেষভাবে আলোচনায় আসে চাকরির কোটাব্যবস্থা সংস্কার ঘিরে ছাত্রদের ক্ষোভ। এতে দাবি করা হয়, এই কোটাব্যবস্থা মূলত শাসক দলের আত্মীয়স্বজনদের জন্য সুবিধাজনক ছিল।

কিন্তু শুধু কোটাব্যবস্থা নয়, বিভিন্ন বড় প্রকল্প ও ব্যাংক লুটপাটের মাধ্যমে সরকারের ঘনিষ্ঠরা কোটি কোটি ডলার পাচার করেছে বলেও অভিযোগ উঠে এসেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থ পাচার—এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার ভিত্তি।

লন্ডনে পাচার হওয়া অর্থ ও টিউলিপ সিদ্দিক বিতর্ক
তথ্যচিত্রে ফোকাস করা হয় যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ এবং বাংলাদেশি শাসকদের সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তির সম্পত্তির তথ্য। এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচনায় আসে শেখ হাসিনার ভাগ্নি, ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। তথ্যচিত্রে বলা হয়, লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় একটি দামি ফ্ল্যাট টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছিলেন ২০০০-এর দশকের শুরুতে, যখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। সম্পত্তিটি হস্তান্তর করেন এমন একজন ডেভেলপার, যার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করা হয়। এ বিষয়টি ঘিরে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় এবং তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন। টিউলিপ সিদ্দিক অবশ্য এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই বলেও দাবি করেছেন।

৩০০ সম্পত্তির মালিক সাবেক ভূমিমন্ত্রী!

তথ্যচিত্রে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কথাও উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, তার মালিকানায় যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তি রয়েছে, যার অনেকগুলো ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) জব্দ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, একটি দরিদ্র দেশের একজন মন্ত্রী কীভাবে এমন সম্পত্তির মালিক হন, তা অবিশ্বাস্য। যেখানে একজন বাংলাদেশি নাগরিক বছরে মাত্র ১২ হাজার ডলার বিদেশে নিতে পারেন।

ব্যাংকের অর্থ লুটপাট নিয়েও উঠে আসে বিস্তৃত আলোচনা।  এই অর্থ পাচারের মূল মাধ্যম ছিল ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডি।

তথ্যচিত্রে আরও বলা হয়, এ লুটপাট চলছিল সবার চোখের সামনে। কিন্তু ভয়, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা সংস্কৃতির কারণে কেউ মুখ খুলত না। বাংলাদেশের মানুষ জানত, প্রতিবাদ করলে হয়তো ‘গায়েব’ হয়ে যাবে।

শেখ হাসিনা ভারতের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় এবং দায়িত্ব পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নতুন গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগ দেন এবং ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি ১১টি ব্যাংকের তারল্য সংকট আছে। ২৯০ বিলিয়ন টাকা সরকারকে ঢালতে হয়েছে, যাতে ব্যাংকগুলো ভেঙে না পড়ে।’

ড. ইউনূস বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে। তিনি বলেন, আগে প্রশাসন ও অর্থনৈতিক খাত সংস্কার করতে হবে। এরপর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ