প্রভাবশালীদের কালো থাবায় বেদখল কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল, যন্ত্রাংশ চুরি

নিজস্ব প্রতিবেদক (কুষ্টিয়া), এবিসি নিউজ, (১২ সেপ্টেম্বর) : ১৯০৮ সালে মাত্র আটটি তাঁতযন্ত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী । এই মিলের যাত্রা শুরু করেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য মোহিনী মোহন চক্রবর্ত্তী। স্থান হিসেবে বেছে নেন তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমাকে। প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই মিলটি একটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়।

অল্প দিনের মধ্যেই এই মিলের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। ইংল্যান্ড থেকে আনা পিতলের হ্যান্ডলুম মেশিন, সঙ্গে পিতলের তৈরি প্রায় ২০০ তাঁত আমদানি করে মিলের উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা হয়। ১৯২০ সালের দিকে মিলে প্রায় তিন হাজার মানুষ কাজ করতেন। মিলে উৎপাদিত দেশি কাপড়ের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। এখানকার উৎপাদিত সুতা ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারে রপ্তানি হওয়ায় মিলটি পুরো এশিয়ার মধ্যে জায়গা করে নেয়।

ইতিহাস-ঐতিহ্যের সেই কুষ্টিয়া মোহিনী মিল বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮২ সালে। এর পর থেকে এ কারখানার জমি বেদখল হতে থাকে। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কালো থাবায় দখল হয়ে যায় মিলের নিজস্ব জমি। একই সঙ্গে রাতের আঁধারে চুরি ও পাচার হতে থাকে কারখানার মূল্যবান সম্পদ ও যন্ত্রাংশ। এখন কারখানা ভবনের দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। লতাপাতায় ঢেকে গেছে লোহার যন্ত্রাংশ। চারদিকে গজিয়েছে বটসহ গাছপালা। পুরো কারখানার চত্বর পরিণত হয়েছে জঙ্গলে।

সেখানে গেলে স্থানীয়রা জানান, কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের ৩৬ একর জায়গার প্রায় অর্ধেকের বেশি জায়গা এখনো আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের পরিবারের দখলে রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিভিন্ন কায়দায় দখল ধরে রেখেছেন তারা। এ ছাড়া পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় কাউন্সিলরাও দখল করে আছেন অনেক জায়গা। এতে সাহায্য করেছেন মোহিনী মিলের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অসৎ কর্মকর্তারা।

মোহিনী মিলের জিএম বাংলো দখলে নিয়েছেন তাইজাল আলী খান। তিনি কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। মিলের ১ নম্বর গেটের সামনের খালি জায়গা দখল করে রেখেছেন তারই ছেলে ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান রনি।

এ ছাড়া মিলপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে সেখানে তৈরি করেছেন বাগানবাড়ি, সন্ধ্যা হলেই সেখানে চলে মাদকের আড্ডা। আর এসব চলে রনির ছত্রচ্ছায়ায়। মিল লাইন কোয়ার্টারের জায়গা দখল করেছেন কুষ্টিয়া আদর্শ কলেজের প্রিন্সিপাল আলতাফ হোসেন। তিনি তাইজাল আলী খানের ভাগ্নে। তার আরেক ভাগ্নে মুসা আলী খান দখল করে আছেন মিলের কোয়ার্টার ও হাসপাতাল কোয়ার্টার এবং মিলের মাঠ।

এ ছাড়া ছোট ছোট ঘর নির্মাণ করে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা ঘরপ্রতি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মিলের রেস্ট হাউস দখল করে রেখেছেন নাসির উদ্দিন, তিনি তাইজাল খানের বাড়ির কেয়ারটেকার। মিলের হাসপাতালের পাশে তাইজাল খানের বাবার নামে একটি ক্লাব তৈরি করে সেখানেও অবৈধভাবে জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে। স্টাফ কোয়ার্টারের জায়গা দখল করে রেখেছেন তার ভায়রা ভাই আমিরুল ইসলামের ভগ্নিপতি মিরাজউদ্দিন।

মিলের হাসপাতালের আরও একটি অংশ দখল করে রেখেছেন ইসমাইল হোসেন ও সাবেক পুলিশ সদস্য শরাফ উদ্দিন (শরিফুল)। সাবেক কাউন্সিলর নিজামুদ্দিন খান একসময় সন্ত্রাসী সংগঠন হামিদুল বাহিনীর ক্যাশিয়ার ছিলেন। তিনিও দখল করে রেখেছেন মিলের সম্পত্তি। মিলের সিনেমা হলের জায়গা দখল করে রেখেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি রবিউল ইসলামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আল-মদিনা ও ডালমিলের ইলেকট্রিশিয়ান পিরু।

মোহিনী মিল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে কারখানার জমি বেদখল হতে শুরু হয়। কারখানার মূল অংশসহ বাইরের কিছু জায়গা (প্রায় সাড়ে ১৬ একর) এখনো মিলের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এ কারখানাটি বিক্রির জন্য লিকুইডেশন সেল বা বিলুপ্তির দরপত্র ১৯৮১ সালের জুনে গঠন করে দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। তবে ৪২ বছরেও এটি বিক্রি করতে পারেনি তারা। এখন লিকুইডেশন সেলের ১৫ জনের বেশি কর্মচারী কারখানাটি দেখভাল করেন। শুধু এ কারখানা নয়, আরও তিনটি কারখানা বিক্রি করতে পারেনি এই সেল। ফলে এ সেলে কর্মরত ব্যক্তিদের বসিয়ে বেতন-ভাতা, কার্যালয় ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ দিতে হচ্ছে সরকারকে। অন্যদিকে বন্ধ থাকায় কারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়াসহ সম্পদের অপচয় হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, ‘যে দলই ক্ষমতাই এসেছে তারা এই মিলটিকে গিলে খেতে চেয়েছে। যার কারণে এই মিলটি আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু সরকারের শুভ দৃষ্টি থাকলে এই মিলটিকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব ছিল। এটি করতে পারলে জেলার বেকার যুবকদের যেমন কর্মসংস্থান হতো, সেই সঙ্গে সরকার হতো লাভবান। কিন্তু কে শোনে কার কথা।’

অবৈধ দখলের বিষয়ে শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলী খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে তিনি পলাতক।

কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের ম্যানেজার মাহাবুল ইসলামের কাছে দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আমার আগে যারা ছিলেন, তারা কোনো নথিপত্র আমাকে দিয়ে যাননি এবং কারা দখল করে রেখেছেন, সে বিষয়েও কোনো কিছু মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়নি হয়তো।’

এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘যদি অবৈধ দখল থেকে থাকে, তাহলে মোহিনী মিলের সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা আমাদের জানালে আমরা দখলদারদের উচ্ছেদ করব।’

প্রসঙ্গত, মোহিনী মিলের প্রায় ৯৯ বিঘা সম্পত্তির পুরোটাই কুষ্টিয়া পৌরসভার মধ্যে। এসব জমির বর্তমান বাজারদর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে এই বস্ত্রকলটি হারিয়েছে তার সব গৌরব। হাতবদলের চক্রে বন্ধ হওয়া মোহিনী মিল এখন শুধু কালের সাক্ষী।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ