র‌্যাবের চার্জশিটে অনিশ্চিত হয়েছে মিল্কী হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ

Milkeyবিশেষ প্রতিনিধি, এবিসিনিউজবিডি :
ঢাকা : র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিটে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ। দীর্ঘ তদন্তের পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিটে হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজে দেখতে পাওয়া প্রধান একজন আসামিকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে অন্যতম কয়েক সন্দেহভাজনকে। র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিট ও নিহতের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গভীর রাতে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ড শপিংমলের সামনে যুবলীগ নেতা তারেক ও তার সহযোগীরা কাছ থেকে মিল্কীকে গুলি হত্যা করে। ঘটনার পর মিল্কীর ভাই মেজর রাশেদ বাদী হয়ে জাহিদ সিদ্দিকী তারেক ওরফে কিলার তারেকসহ ১১ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৪-৫ জনকে আসামি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার রাতেই র‌্যাব-১ এর হাতে আটক হয় তারেক। দু’দিন পর সে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের ১৫ এপ্রিল র‌্যাব-১ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. কাজেমুর রশীদ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। র‌্যাবের দেওয়া এই চার্জশিটের বিরুদ্ধে গত ৬ জুন মামলার বাদী মেজর রাশেদ নারাজি প্রদান করেন। নারাজির উপর শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম তারেক মঈনুল ইসলাম ভূইয়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ’কে (সিআইডি) মিল্কী হত্যা মামলা নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেন।
এ দিকে র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিট নিয়ে নিহতের পরিবারের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের অভিযোগ, র‌্যাব তদন্তের নামে এই হত্যা মামলার এজহারভুক্ত গুরুত্বপূর্ন কয়েকজন আসামিকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। অপরদিকে র‌্যাবের চার্জশিটের তথ্য অনুযায়ী পরোক্ষভাবে জড়িত মামলার এজাহারে ৭নং আসামি হিসেবে উল্লেখ থাকা ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তরের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলকে ১নং আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখতে পাওয়া কিলার তারেকের পাশে দাড়িয়ে গুলি করা আমিনুল ইসলাম হাবিবকে ৫নং আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে মামলার এজহারভুক্ত অন্যতম আসামি মহানগর যুবলীগ দক্ষিনের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল আলম প্রকাশ ওরফে আরিফ ভূইয়া ও মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। পরিবারের দাবি, র‌্যাব এসব করে মামলার মূল ভিত্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। আর এতে করে মিল্কী হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাদীর মামলায় যারা আসামি ছিলেন
ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিনের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে হত্যার ঘটনায় তার ভাই মেজর রাশেদ বাদি হয়ে ১১ জনের নামে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হচ্ছেন- ১. জাহিদ সিদ্দিক তারেক ওরফে কিলার তারেক, ২. তুহিনুর রহমান ফাহিম, ৩. সৈয়দ মোস্তফা আলী ওরফে রুমী, ৪. মোহাম্মদ রাসেদ মাহমুদ, ৫. সাইদুল ইসলাম ওরফে নুরুজ্জামান, ৬. মো. সুজন হাওলাদার, ৭. মো. সাখাওয়াৎ হোসেন চঞ্চল, ৮. মো. সোহেল, ৯. মো. জাহাঙ্গীর মন্ডল, ৯. জাহিদুল ইসলাম টিপু, ১০. ওয়াহিদুল আলম প্রকাশ ওরফে আরিফ ভূইয়া। এছাড়া আরো অজ্ঞাত ৪/৫ জনের কথা উল্লেখ করা হয়।

র‌্যাবের চার্জশিটে যা উল্লেখ করা হয়েছে
র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘ঘটনাস্থল হইতে উদ্ধার করা ভিডিও ফুটেজ এর মাধ্যমে সনাক্ত হওয়া আসামি তারেককে গুলিবিদ্ধ ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় উত্তরা ফরচুন হাসপাতাল হইতে অপরাপর সহযোগি আসামিসহ র‌্যাব-১ গ্রেফতার করে। র‌্যাব কর্তৃক গ্রেফতারকৃত আসামি তারেক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে যে, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে বাদীর ভাইকে আসামি জাহিদ সিদ্দিক তারেক নিজে এবং ধৃত আসামি তুহিনুর রহমান ফাহিম, সৈয়দ মোস্তফা আলী রুমি, মো. রাশেদ মাহমুদ, সাইদুল ইসলাম প্রকাশ নুরুজ্জামান, মো. সুজন হাওলাদার এবং পলাতক আসামি সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, মো. সোহেল, জাহাঙ্গীর মন্ডলসহ আরো ৪/৫ জন আসামি বাদীর ভাই রিয়াজুল হক খান মিল্কীকেগুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল হইতে মটর সাইকেল ও গাড়ি যোগে পূর্ব দিকে পালিয়ে যায়।’
র‌্যাবের চার্জশিটে আরো উল্লেখ করা হয়- ‘ঘটনার ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে স্বাক্ষী ও গ্রেফতারকৃত আসামিদেও সহায়তায় ঘটনায় সরাসরি অংশ গ্রহনকারী আসামি কিলার তারেক, আমিনুল ইসলাম ও সোহেল মাহমুদকে সনাক্ত করনোর ব্যবস্থা করি। বিশেষজ্ঞদের মতামতে জানা যায় যে, ঘটনার সময় জাহিদ সিদ্দিক তারেক ও আমিনুল ইসলাম বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা ফায়ার করিয়া ভিকটিমকে হত্যা করিয়াছে।’
এতে আরো বলা হয়- ‘নিহত মিল্কী ও তারেকের মধ্যে এলাকার আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক পদ, ডিসিসি’র নির্বাচন, জমি দখল ও বিভিন্ন উৎস্য হইতে প্রাপ্ত অর্থেও ভাগ-বন্টন নিয়ে তাদেও মধ্যে চাপা বিরোধ চলিয়া আসিতেছিল। তাদের এই বিরোধ এক সময়ে প্রকাশ্যে রুপ নেয়।’
চার্জশিটের শেষে উল্লেখ করা হয়- ‘ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, জব্দকৃত আলামত, স্বাক্ষীদের জবানবন্দী ও আসামিদের কা:বি: ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দীর আলোকে এই হত্যার ঘটনায় কিলার তারেকের নেতৃত্বে একই উদ্দেশ্যে পরস্পর সহযোগিতায় আসামি ১. জাহিদ সিদ্দিক তারেক, ২. মো. আমিনুল ইসলাম হাবিব, ৩. মো. সোহেল মাহমুদ, ৪. মো. আরিফ, ৫. মো. চুন্নু মিয়া, ৬. সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকিয়া পিস্তল ও রিভালবার দ্বারা গুলি কওে ভিকটিম রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে হত্যা করার অপরাধ এবং আসামি ১. ফাহিমা ইসলাম লোপা, ২. মো. শহিদুল ইসলাম, ৩. মো. জাহাঙ্গীর মন্ডল, ৪. মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ৫. মো. ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ অত্র মামলার হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করার অপরাধে উপরোক্ত সকল আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোড ৩০২/৩৪/১০৯ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমানিত হয়।’
র‌্যাবের এই তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বাদীর দায়ের করা মিল্কী হত্যা মামলার ৭নং আসামী সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলকে ৬নং অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ র‌্যাবের আদালতে দেওয়া চার্জশিটে ভিডিও ফুটেজে গুলি করতে দেখতে পাওয়া আমিনুল ইসলাম হাবিবকে ৫নং আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর উদ্দেশ্যপ্রোনদিতভাবে ১নং আসামি করা হয় সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলকে।
সুুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ক্ষোভ
মিল্কি হত্যা মামলায় র‌্যাবের দেওয়া তদন্ত রিপোর্ট প্রসঙ্গে দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, ‘বিচারাধীন কোন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে যেহেতু এই মামলার পূন: তদন্ত চলছে, সে কারণে এ বিষয়ের অনিয়মগুলো নিয়ে কথা বলা যায়।’ বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এই মামলায় র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিট নিয়ে নিহতের পরিবারের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। করাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, এই মামলার বাদী নিহত মিল্কীর আপন ভাই। তিনি যে আসামির তালিকা দিয়েছেন, র‌্যব তদন্ত করে তা পরিবর্তন করেছে। এটাও ধরে নিলাম হতেই পারে। তবে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে গুলি করতে দেখতে পাওয়া ব্যক্তির নাম কেন ৫নং আসামির তালিকায় থাকবে? আর যাকে দেখতে পাওয়া যায়নি এমন একজনকে কেন প্রধান অর্থাৎ ১নং আসামি করা হবে? এগুলো কার স্বার্থে করেছে, তা তদন্ত কর্মকর্তাই ভাল বলতে পারবেন।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘র‌্যাবের তদন্ত রিপোর্টটি আমি দেখেছি। দেখেছি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ। এই ভিডিও ফুটেজই এ মামলার অন্যতম আলামত বা স্বাক্ষী। ভিডিও ফুটেজে দুই সন্ত্রাসীকে গুলি করতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে প্রথম জন কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত জাহিদ সিদ্দিক তারেক। আর একজন আমিনুল ইসলাম হাবিব। প্রথমজন নিহত হলে যথাক্রমে দ্বিতীয়জনই ১নং আসামি হওয়ার কথা। পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিষয়টিতো পরে আসবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook
ব্রেকিং নিউজ