যুদ্ধাপরাধ বিচারে সমর্থন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
জে.ইউ জুবায়ের, নির্বাহী সম্পাদক, এবিসি নিউজ বিডি, নিউ ইয়র্কঃ একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারে বিশ্বনেতাদের সর্বাত্মক সমর্থন চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে স্থানীয় সময় বিকালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা দেশে ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন দিয়েছে। ২ লক্ষ নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে।”
যুদ্ধাপরাধীর বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বিচারকাজ পরিচালনায় সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়েছে।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিশ্ব নেতাদের সমর্থন চেয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হবে । দেশে শান্তি ও অগ্রগতি চিরস্থায়ী রূপ নেবে। আমাদের এ উদ্যোগকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা দেয়ারও আহ্বান জানান।
পাশাপাশি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকারমূলক কৌশল গ্রহণে উন্নত বিশ্বকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অনেক অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার অভিঘাত মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সমুদ্রের পানির স্তর ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে এবং অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।”
‘জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে’ পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকারমূলক কৌশল গ্রহণে উন্নয়ন সহযোগীদের দায়িত্ব স্মরণ করে দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিশ্বনেতাদের কাছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত পণ্যের প্রবেশাধিকার, বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অবাধ যাতায়াত এবং উন্নয়ন সহযোগীদের জিডিপির একটি অংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ দেয়ার নিশ্চয়তা চান।
তিনি বলেন, এমডিজি অর্জন এবং ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে উন্নয়ন সহযোগীদের ‘অফিসিয়াল’ উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে তাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের শূন্য দশমিক সাত শতাংশ এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ওডিএ হিসাবে শূন্য দশমিক দুই শতাংশ দেওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।
“ব্রেটন উডস্ ইনস্টিটিউশনস ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মতপ্রকাশে সমান অধিকার এবং জিএটিএস অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অবাধ যাতায়াতের নিশ্চয়তা দিতে হবে।”
একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ ও টেকসই বিশ্ব গড়তে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এসব বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সকলের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। কোনো ব্যক্তি বা জাতি পিছিয়ে থাকবে না।”
২০২১ এর মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, তার সরকারের লক্ষ্য এমডিজি’র সাথে তাল মিলিয়ে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা।
বাংলাদেশকে এখন ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল’ এবং ‘দক্ষিণ এশিয়ার মান বাহক’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় বলে বিশ্বনেতাদের অবহিত করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের একটি বড় অংশ জুড়ে দেশের উন্নয়নে তার সরকারের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা ও পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
শিক্ষা খাতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার মেয়েদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, এক কোটি ১৯ লক্ষ শিক্ষার্থীকে মাসিক উপবৃত্তি ও মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া নিশ্চিত করেছে।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনো সক্রিয় রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২৪ জনের মৃত্যুসহ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বিরোধীদলের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী “এসব ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার সরকার সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমরা জঙ্গিবাদ বিরোধী ও অর্থপাচার বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছি।”
এছাড়া নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বিশ্বনেতাদের অবহিত করেন শেখ হাসিনা।
এ সময় তিনি তার সরকারের সময়ে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের হয়ে যাওয়া পাঁচ হাজার সাত’শো ৭৭টি নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বলেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম।
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সংখ্যক সৈন্য প্রেরণকারী দেশ হিসাবে উল্লেখ করে হাসিনা বলেন, “আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভূমিকা ন্যায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত যা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নিরস্ত্রীকরণকে সমর্থন করে।”