মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই আদেশ দেন।
তিনি বলেন, অপহরণ, নিযার্তন ও হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি ঘটনায় মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।
বিচার ঠেকাতে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের মধ্যেই ‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ দলটির সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড কাযর্কর করার নির্দেশ দেন বিচারক।
তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া না হলে ন্যায়বিচার হবে না বলেও রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল প্রধান।
স্বাধীনতার পর চার দশকে এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করা কোনো রাজনীতিবিদের ফাঁসির আদেশ হলো। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন মুজাহিদ।
তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হওয়া পাঁচ অভিযোগের মধ্যে এক, ছয় ও সাত নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হয়েছে মুজাহিদের। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হত্যা-নিযার্তনের অভিযোগও রয়েছে এর মধ্যে।
এছাড়া পঞ্চম অভিযোগে জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমিসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটকে রেখে নির্যাতন এবং কয়েকজনকে হত্যার ঘটনায় তাকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে হত্যার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হওয়ায় কারাদণ্ডের আদেশ তার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।
দুটি অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলেও তাতে এই জামায়াত নেতার সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে।
উপস্থিতিতে রায়ের ৩৭ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসারের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। অপর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া পড়েন দ্বিতীয় অংশ।
বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ওই বাহিনীর ওপর তার ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ থাকার বিষয়টিও প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
৬৫ বছর বয়সী মুজাহিদের সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং আসামির জেলা ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
অপরাধ সংঘটনের চার দশকেরও বেশি সময় পরে হলেও বিচারের রায় পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনও।তবে রাযে ‘ভুল’ হয়েছে মন্তব্য করে আপিল করার কথা জানিয়েছেন মুজাহিদের আইনজীবী।
বদর নেতা থেকে মন্ত্রী
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে।
১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
রাজেন্দ্র কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে মুজাহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেন বলে তার আইনজীবীর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।
তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।
একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।
কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান তিনি।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।
মামলার ইতিবৃত্ত
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে ছয় হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এর ১০ দিন পর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়।
এরপর প্রসিকিউশনের আবেদনে মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই গত বছর ২১ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।
এরপর ২৬ অগাস্ট শাহরিয়ার কবিরের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষীদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল ও শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক শাহীন রেজা নূরও ছিলেন।
অন্যদিকে মুজাহিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছোট ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর।
চলতি বছর ৫ জুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারক।
ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়।
তৃতীয় রায়ে নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে জামায়াতের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
এরপর গত ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
আগের রায়গুলোর সময় জামায়াতের সহিংসতার প্রেক্ষাপটে রোববার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘিরে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন।
ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। আর রায়ের জন্য আসামি মুজাহিদকে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে মঙ্গলরাই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় একটি মাইক্রোবাসে করে।
আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইব্যুনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়। তারা জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতেও স্লোগান দেন।